আহলে হাদীস নামটা বাংলাদেশে একটি আলোচিত নাম। আহলে হাদীস বিষয়ক প্রচুর গ্রন্থ বাংলাতে রচিত হয়েছে। একসময় এসব বিষয়ে আগ্রহ থাকায় প্রচুর বই সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেছে সবগুলো বই-ই ঘুরেফিরে একই জিনিস। রফয়ে ইয়াদাইন, আমীন জোরে-আস্তে, তারাবী আট না বিশ, অমুকরা ইংরেজদের সৃষ্ট এসব আলোচনাতেই সব বই আবদ্ধ। ঘুরেফিরে সেই পুরোনো কাসুন্দি। পুরোনো আলাপ। পুরোনো কথাবার্তা। ফলে এই জাতীয় বই কেনা-পড়া বাদ দিয়েছি অনেকদিন হলো।
সেদিন দোকানে দেখলাম হলুদ মলাটের চকচকে একটা বই। উপরে আহলে হাদীস লেখা দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু বইটার গেটাপ দেখে অনাগ্রহ সত্ত্বেও বইটা হাতে নিলাম। ভেতরের বিষয়বস্তু দেখার জন্য না। বরং বইটার গেটাপ দেখার জন্য। পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে সূচিতে চোখ পড়াতে থেমে গেলাম। দেখলাম ভেতরের বিষয়বস্তু পুরোনো কাসুন্দি না। নতুন কিছু উপস্থাপিত হয়েছে এতে। এবার একটু আগ্রহী হয়ে উঠলাম। পুরোটা সূচি পড়ে দেখলাম সেখানে ইখতিলাফি মাসআলা বা কাউকে ইংরেজদের দালাল বানানোর কোন প্রচেষ্টা নাই। বরং নিরেট একটা তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন লেখক। ভাবলাম তাহলে তো এটি পড়তেই হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। বাসায় যখন ফিরে এলাম তখন ব্যাগে ভরা ছিলো সেই বইটি।
বইটির বিষয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে, লেখক শুরুতে লম্বা একটা ভূমিকা এনেছেন 'লেখকের জবানবন্দি' শিরোনামে। সেখানে তিনি নিজের জীবনের কিছু বিষয়, বইটি লেখার প্রেক্ষাপট ও রচনা-পদ্ধতি তুলে ধরেছেন। আরবী অনেক বইপত্রে 'মানহাজুল কিতাব' বলে একটা বিষয় থাকে। বইটার রচনা-পদ্ধতি ও বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করা হয় সেখানে। বাংলা বইপত্রে এটি তেমন দেখা যায় না। এই বইতে বিষয়টি উপস্থিত দেখে ভালো লাগলো। সবচে বেশি ভালো লাগলো লেখক বলছিলেন যে, আমার এই বই কারো কারো মতের বিপরীতে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যাতে পারস্পরিক সৌহার্দ্যকে আমরা না ভুলি। মতোপার্থক্য তো পূর্বযুগ থেকে চলে আসা স্বাভাবিক একটা বিষয়। এর জন্য মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে ভুলে যাওয়া যাবে না। এই একটি বিষয় যদি আমাদের সমাজের মুসলিমরা মেনে নিতো তবে আজ মাযহাব-মানহায নিয়ে এতো দাঙ্গাহাঙ্গামা হতো না।
তারপর লেখক শুরুতেই আহলে হাদীসের শতাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন। মুহাদ্দিসদের বিভিন্ন প্রয়োগকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। প্রতি যুগে মুহাদ্দিসরা আহলে হাদীস বলতে কী বুঝতেন ও বোঝাতেন তা তুলে ধরেছেন। এর জন্য যুগ যুগ ভাগ করে প্রথম হিজরী শতক থেকে নিয়ে দশম হিজরী শতক পর্যন্ত সময়কে তিনি বেছে নিয়েছেন এবং প্রত্যেক শতকের বিখ্যাত ক'জন মুহাদ্দিসদের বক্তব্য এনেছেন। শুরুতেই সেই মুহাদ্দিসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার কারণে শতাব্দীভিত্তিক অনেক মুহাদ্দিসের সাথে পাঠকের স্বয়ংক্রিয় পরিচয় ঘটে যায়। বিয়টি মজারই ছিলো। সবশেষে পরিশিষ্ট আকারে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এই অংশটি আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছিলো। এতে ইমাম আহমাদ, বুখারী, আলী ইবনুল মাদীনী, ইবনে তাইমিয়া, বিশারী মাকদেসীসহ যাদের বক্তব্য আমাদের দেশের আহলে হাদীসরা নিজেদের নামের স্বপক্ষে ব্যবহার করেন তার পর্যালোচনা করেছেন। পড়লেই বুঝা যায় লেখককে বেশ মেধা খরচ করতে হয়েছে এর জন্য।
বইয়ের একটি প্রশংসনীয় দিক হলো এতে আদব বজায় রেখে আলোচনা করা হয়েছে। কাউকে আক্রমণ বা আঘাত করা হয় নি। শিষ্টাচারপূর্ণ অবস্থানে থেকে ইলমী বিষয়ে কীভাবে আলোচনা করতে হয় সেটা বুঝার জন্য বইটি আদর্শ হতে পারে।
একটা বিষয়ে লেখককে বেশ বিচক্ষণ মনে হলো। তিনি সজ্ঞানে পুরো বইতে সরাসরি কাউকে খণ্ডন করার পন্থা পরিহার করে চলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে যাদের বক্তব্য খণ্ডন হয়ে গেছে তাদের কথা টীকাতে এনেছেন। মূল বইতে নয়। বিষয়টি তিনি ভূমিকাতেও তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন, এটি খণ্ডনমূলক বই না হবার কারণে এই পদ্ধতি তাকে অবলম্বন করতে হলো।
এই বইয়ের একটা দুর্বল দিক- যেটা আমার কাছে প্রতিভাত হয়েছে, তা হলো এতে কেবল আহলে হাদীস বিষয়ক মুহাদ্দিসদের বক্তব্যগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। যদি তা না করে সামগ্রিকভাবে মুহাদ্দিসদের বাইরে অন্যদের বক্তব্যও আনতেন তাহলে বইটি আরও পূর্ণতা পেতো এবং লেখক যে গবেষণার কথা বলেছেন সেটা আরও তথ্যবহুল ও তাৎপর্যমণ্ডিত হতো। তাছাড়া পৃষ্ঠাসজ্জাও আরও সুন্দর হতে পারতো। তবে কাগজ আর বাঁধাই ছিলো সন্তোষজনক।
আমাদের দেশে মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়ে লেখতে গিয়ে গবেষণামূলক রচনার উপস্থিতি খুব একটা দেখে যায় না। সেহিসেবে বইটি একটি অভাব পূরণ করেছে বলে মনে হলো। তাছাড়া স্বতন্ত্রভাবে আহলে হাদীস পরিভাষাটি নিয়ে বিস্তৃত আকারে রচনা করা এটি প্রথম বই হিসেবে লেখক দাবী করেছেন। তার এই দাবী কতোটা বাস্তব তা পুনর্বিচার্য বলে মনে হয়। যতোদূর মনে পড়ে মাওলানা যুবায়ের সাহেবেরও এই ধরনের একটা বই আছে। সেটা আমার পুরো পড়া না হলেও আংশিক পড়ার সুযোগ হয়েছিলো কোন এক সময়। অবশ্য সেটা
কেবলই এই পরিভাষাকে ভিত্তি করে রচিত না। সেখানে আরও অনেক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। যদি এই বিচারে লেখক দাবী করে থাকেন যে- 'পুরোটা বই কেবলই একটি পরিভাষার বিশ্লেষণ ও বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে রচিত' তাহলে হয়তো তার দাবী ঠিক হতে পারে। অবশ্য যুবায়ের সাহেবের বইটা এই বইয়ের মতো সেটা এতোটা গোছালো, প্রাঞ্জল আর সুখপাঠ্য ছিলো না। ছাপার মানও ছিলো বেশ নিম্নতর।
পরিশেষে বলবো, 'সালাফদের দৃষ্টিতে আহলে হাদীস' বইটি আহলে হাদীস বিষয়ক রচনাতে একটি নতুন ও ভিন্নতর সংযোজন। এই বিষয়ে এমন গবেষণা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। এতে আসাদুল্লাহ গালিব সাহেবসহ আরও যেসব লেখক আহলে হাদীস নামকে ভিন্ন অর্থে প্রবাহিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন তাদের সে চেষ্টা খণ্ডন হয়ে যায়। যারা এই বিষয়ে তাহকীকী রচনার স্বাদ পেতে চান তারা বইটি পড়তে