মোমিন যদি মোমিনের আয়না হয়, তাহলে মিম্বর হবে সমাজের আয়না। অন্তত তা-ই হওয়া উচিত এবং সোনালি যুগের মিম্বরগুলো তেমনই ছিল। মিম্বর ছিল নবুয়তের সিংহাসন। ছিল প্রধান বিচারকের আসন। জনমানুষের সামনে রাষ্ট্র পরিচালকরা কৈফিয়তের আদলে মিম্বরের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেন সসংকোচে। আজ যদি মসজিদকে অন্তত সমাজের সেমিনার কক্ষও ধরা যেত, তাহলেও মিম্বরই ঠিক করে দেওয়ার কথা এখানকার গতি-প্রগতি এবং সুশীল কালচার। মসজিদের আজানই হওয়ার কথা সময়ের ঘড়ি। মসজিদই হতো তাহলে সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু পরম দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, মসজিদ কালচার নির্মাণ করতে পারছে না এখন আর। পারছে না আমাদের কাঙালিপনা রোধ করতে। উপরন্তু ধীরে ধীরে মসজিদই ভরে যাচ্ছে কাঙালে। ফলে আমরা মসজিদ হারিয়েছি এবং মসজিদ হারিয়েছে আমাদের। এর ফলও হয়েছে গভীর, কর্কটরোগের মতোই খেয়ে ফেলছে আমাদের ঐতিহ্য, ইবাদতের মরুদ্যানেও এসেছে দুর্ভিক্ষ। বারে বারে তাই আমাদের হৃদয়ের অন্দরে করাঘাত করে মদিনার মসজিদের চিত্র, রাসুল (সা.) এর খুতবার দৃশ্য এবং মক্কায় আরাফার ময়দানে কিংবা বাইতুল্লাহ ঘিরে সাহাবিদের জলসায় রাসুলের হেদায়েতের বাণী নিঃসরণের কল্পনা। ফলে আমরা প্রায়ই ভাবী, বড় আশা নিয়ে মক্কা-মদিনার পানে তাকাই, সেই দূরদেশ থেকে আজও কোনো শাশ্বত বার্তা আসে কি না। কালের আবর্তে রাসুলে আরাবি (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার মঞ্চে আজ যাদের অধিষ্ঠান তারা আমাদের মুক্তির কোনো উপায় বলে দেন কি না। দূরদর্শন আর অন্তর্জালের হাত ধরে কখনও-সখনও ছিটেফোঁটা বিন্দুর আভাস পেলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষার প্রাচীর। মক্কা-মদিনার নির্দেশনা আমাদের জানা হয় না। এই বইÑ এতক্ষণ যার ভূমিকা আলোচনা হলোÑ ‘মক্কা-মদিনার খুতবা’ যাবতীয় আড়াল-আবডাল সরিয়ে আইম্মায়ে হারামাইনের বার্তা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখছি, কী ভাষা, কী বক্তব্য, যেন হেরার আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে অবিরল। সমাজের আয়নার মতো প্রতিটি সংকট, হোক তা পরিবার কিংবা রাষ্ট্রের, হোক তা ব্যক্তিক কিংবা নৈর্ব্যক্তিক, কোনো কিছুই হারামাইনের ইমামদের নজর এড়ায় না। তারা দৃপ্তস্বরে উচ্চারণ করেন সেই সত্য, যা আপনাকে আঘাত করে, অথচ আপনি শুনতে চান। কেননা এখনও মুসলিম বিশ্বের এমন ঘোর দুর্দিনেও মসজিদের প্রতি যেমন মানুষের ভরসা অটুট রয়েছে, মিহরাবের অধিপতির পেছনে নিমগ্ন সাধনায় যেমন প্রার্থনায় আকুল হয় মানুষ, মিম্বরের প্রতিও তাদের তেমন অসীম প্রত্যাশা বিরাজ করে। যেহেতু জাতীয় সংকট ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছেÑ এটাই মানুষকে আরও বেশি বিনোদনমুখী করে দিচ্ছে। কেননা মানুষ আরও বেশি কচ্ছপের মতো মাথাটা শক্ত খোলসের নিচে লুকায় এই সময়। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে সে সংকটের কথা ইচ্ছা করেই ভুলে থাকতে চায়। সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তার পেছনে কারণ কিন্তু এটাই। হারামাইনের ইমামরা সেই ফেইসবুক এবং টোটাল সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়বস্তুকেও তাদের খুতবার শিরোনাম বানান। শাহাদত অঙ্গুলির হেলনে দেখিয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এপিঠ-ওপিঠ। আবার মুসলিম জীবনে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তাও ব্যাখ্যা করেন পরক্ষণেই। কিছু ভালো মানুষ আছেন, তারা পরিবারের অবক্ষয় দেখে কেঁপে ওঠেন। দেখেন তার ছেলেমেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে, বউ হয়ে যাচ্ছে পর। শুধু টাকা রোজগার ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই সংসার জীবনে। তারা আসেন মসজিদেÑ শান্তির মখমলের খানিকটা পেলব পেতে। কেউ কেউ গাজালির ‘নির্জনতার ইবাদত’ অধ্যায় অনুশীলন করতে চান। হারামাইনের ইমামরা তাদের সামনে পারিবারিক সহিংসতার স্বরূপ তুলে ধরেন, বাতলে দেন কারণ ও প্রতিকারও। তাদের খুতবায় উঠে আসে নারীর ভালোবাসার কথা, বনেদি ও সম্ভ্রান্তবোধের কথা। এমনকি তারা শুধু মসজিদে বসে মসজিদের সম্মান ও মর্যাদার অধরা আলাপ সারেন না। তারা চিৎকার করে বলেনÑ মসজিদ কি ইবাদতের স্থান না হয়ে ইবাদতের বস্তুতে পরিণত হচ্ছে? বোঝান, মসজিদ কখন মানুষের জন্য, আর মানুষ কখন মসজিদের জন্য। জানতে চান, মসজিদের জন্য যতটা ছুটে যায় মানুষ, মানুষের জন্য ততটা নয় কেন। মসজিদমুখী কালচার না থাকার কুফল কত গভীর। অথচ মসজিদই ছিল আমাদের ঐক্যের শেষ প্লাটফর্ম। ধীরে ধীরে তা-ও কি বরবাদ হয়ে যাবে? হারামাইনের খুতবাগুলো তাই নিছক ভাষণ নয়, শুধু গলাবাজি নয়, শুক্রবারের নামাজে যেই বিরাট সংখ্যক শিক্ষিত ভদ্র শ্রেণি সামনের কাতারে বসে আহ্-উহ্ করেনÑ তাদের মনোরঞ্জনের রসদ নয়, বরং এ হলো খঞ্জরের মতো ধারালো ফলা, যা সমাজের জখমকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে। মার্জিত, নিরীহ এবং ঝোপবুঝে কোপ মারার মতো নিরীহ খতিবের রসের সংলাপ নয় তাদের খুতবা। এ হলো নবীর ওয়ারিশদের বুকের আওয়াজ। হৃদয়ের স্পন্দন। ইমামকেও যারা ছাপোষা কর্মচারী ছাড়া কিছু মনে করেন না, বরং টিভির সামনে মাদানি-হামদানি জাতীয় বক্তাদের নতুন নতুন চমক লাগানো তথ্য তাদের উদ্দীপিত করে, তাদের এ গ্রন্থ নজরানা দেওয়া উচিত, হারামাইনের বক্তব্য তাদের জানা উচিত। তাদের চিন্তা বদলে যাবে। বিষয় সন্নিবেশ এত দারুণ, অভিনব ও আধুনিক এবং আলোচনার ভেতরপাঠে আয়াত-হাদিস-যুক্তি-দরদের মিশেল এতটাই সাজুয্যময় যে, একেকটি খুতবা পাঠ করতে করতে পাঠক ইসলামের একেকটি আকাশ ছুঁয়ে আসবেন অনায়াসে, অথৈ সমুদ্রে গভীরে ডুব দিয়ে নীরবে মুক্তো উঠানোর মতো অনুভূতি অর্জন করবেন। বিশেষ করে এদেশের নিরীহ খতিবদের এ গ্রন্থের প্রতিটি লাইন পাঠ করা উচিত, সম্ভব হলে মূলপাঠ দেখে নিলে কিংবা রেকর্ডেড খুতবা শুনে নিলে তারা আরও বেশি উপকৃত হবেন। হজ-ওমরার অভিযাত্রীদের জন্য এ এক মূল্যবান পাথেয়। গত এক বছরে (১৪৩৮ হিজরি) মক্কার বাইতুল্লাহ ও মদিনার মসজিদে নববিতে ১৮ জন ইমামের প্রদত্ত ৬৬টি খুতবা সংকলিত হয়েছে এ গ্রন্থে। মদিনার খুতবাগুলো অনুবাদ করেছেন আরবি সাহিত্যের নিভৃত সাধক মাওলানা মাহমুদুল হাসান জুনাইদ এবং মক্কার খুতবাগুলো করেছেন বিদগ্ধ লেখক খতিব সাংবাদিক মাওলানা আলী হাসান তৈয়ব; যিনি আবার প্রতিটি খুতবা নিজে সম্পাদনা করে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ-এ প্রকাশও করেছেন। একে দক্ষ আরবি-বোদ্ধা লেখকদ্বয়ের হাতে চমৎকার ভাষায় অনুবাদিত, উপরন্তু সম্পাদক নিজেই হজের সফরে হারামাইনের ইমামদের সাক্ষাতে ধন্য হয়ে তাদের দোয়াও নিয়েছেন, যা গ্রন্থটিকে আরও বেশি মহিমা দিয়েছে, বলাই বাহুল্য। বইয়ের ভাষায়ও তার ছোঁয়া লেগেছে নিশ্চিত। এতটাই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে অক্ষরগুলো, যেন রাহসিক গল্পের মতো টেনে নিয়ে যায় গহিনে। পড়তে পড়তেই মনে হয় ওই তো ওই শোনা যায় হারামের মিম্বর ধ্বনিÑ ইয়া আইয়ুহান্নাস ইত্তাকু আনিল মায়াসি ওয়াল জুনুব…।